মহুয়া চিনাপ্পা তাঁর সদ্য প্রকাশিত ছোট গল্পের সংকলন নৌটঙ্কি সালা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন

শ্রীজিৎ চট্টরাজ : ক্রাইম ব্রাঞ্চ।

 ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ কথা/ নিতান্ত সহজ সরল,/ সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু চারটি অশ্রুজল।/ নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,/ নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।/অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ। সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের বর্ষা যাপন কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেন ছোট গল্পের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। এডগার এ্যালেন পো বলেগেছেন, আধ ঘণ্টা থেকে দু ঘণ্টার মধ্যে   যে সাহিত্য রচনায় চরিত্রের বিন্যাসে কাহিনী পড়ে ফেলা যায়, সেটাই ছোট গল্প। মোঁপাসার হাত ধরে বিশ্ব সাহিত্যে ছোট গল্পের যে উদ্ভব, আজ গতিশীল জীবনে তার বিস্তার বাড়ছে।

     বাঙালির ইতিহাসে সাহিত্যচর্চায় পুরুষ প্রাধান্য থেকেছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু বঙ্গ নারীর ভূমিকা যে ছিল না, এমন নয়। বরং উপেক্ষিতই থেকে গেছেন বঙ্গ নারী কবি ও সাহিত্যিকেরা। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী লেখার তিন বছরের মধ্যে কামিনী দেবী লেখেন প্রথম উপন্যাস মনোত্তমা। সময়টা ১৮৬৮।এরপর ১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী লেখেন দীপ নির্মাণ। সময়টা ১৮৭৬। ৭০ দশক পর্যন্ত বাঙালি বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বই উপহার দিতেন।আমরা জেনেছিলাম প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, আশাপূর্ণা দেবী , রাধারাণী দেবী, প্রতিভা বসু বা মৈত্রেয়ী দেবীর নাম। যদিও উপেক্ষিত থেকে গেছেন বেগম রোকেয়া।  সাহিত্যপিপাসু বাঙালির কাছে বই যখন উপহারের তালিকায় ব্রাত্য হয়ে গেল,নতুন প্রজন্মের কাছে এঁরা হারিয়ে গেলেন। তবে ডিজিটাল যুগের একটি সান্ত্বনা আজি হতে শতবর্ষ পরে অন্তত তথ্য সংরক্ষিত হবে আধুনিক যুগের শিল্পী সাহিত্যিকদের।

      আধুনিক যুগের এমনই এক লেখিকা মহুয়া   চিনাপ্পা। বৈবাহিক সূত্রে তামিল পরিবারের বধূ মহুয়ার রক্তের সম্পর্ক অধুনা বাংলাদেশের। বঙ্গ বিভাজনের  ট্র্যাজিক পরিণতিতে মহুয়ার অভিভাবক চলে আসেন ভারতের দিল্লিতে। মাস কয়েক বয়সে পরিবারের সঙ্গে চলে যান শিলংয়ে। সেই শিলং যেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন শেষের কবিতা, রক্তকবরী।লিখেছেন শিলংয়ের  চিঠি। গর্মি যখন ছুটলো না আর পাখার হাওয়ায় সরবতে, ঠান্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলং নামক পাহাড়ে। এখানেই বড় হওয়া মহুয়ার। বাড়ির পরিবেশে প্রবাসী বঙ্গ তনয়া মহুয়া মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত হন। কিন্তু রাজনৈতিক আবর্তে বাঙালি খেদাও আন্দোলনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার দিল্লিতে   প্রত্যাবর্তন। তারপর কলকাতা।এখন বাস বেঙ্গালুরুতে এই দীর্ঘ সফরে শিলংয়ের কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ও তাঁদের জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের সাক্ষী হয়ে থাকা নিয়ে লিখেছেন  কিছু ছোট গল্প। এমন ১৫ টি ছোট গল্প নিয়ে মহুয়া তাঁর জন্মমাস ফেব্রুয়ারিতে এই বছর  প্রকাশ করলেন প্রথম ছোট গল্পের সংকলন নৌটঙ্কী শালা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ শিরোনামে ইংরেজি গ্রন্থ। প্রকাশক ওকব্রিজ  পাবলিশিং। 


      
     নৌটঙ্গী শালা একটি হিন্দি শব্দ। যার অর্থ সঙ্গীত নৃত্য ও উচ্চমাত্রার  লৌকিক সংলাপের সমষ্টি।ইংরেজিতে বলা যায় স্ল্যাং । সহজ বাংলায় চড়া নাটুকে। সুতরাং নামকরণের সার্থকতা কতটা সেটা গল্পগুলি না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়। কেননা সাংবাদিকদের কোনো বই দেওয়া হয়নি ।বাংলাভাষার প্রতি যে আবেগের কথা লেখিকা মহুয়া  বারবার উল্লেখ করেন  তার প্রেক্ষিতে আশা রইলো বিশ্বজুড়ে যে সাহিত্যপ্রেমী কোটি কোটি বাঙালি আছেন তাঁদের জন্য আগামী সৃষ্টি যেন তাঁর বাংলায় হয়।

       এদিনের অনুষ্ঠানে মহুয়া বলেন, নারীর টানের সঙ্গে মা শব্দের যে অনুরণন, সেখান থেকেই মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাঁর আবেগ। তাই মহুয়া নামের ইংরেজি উচ্চারণ মাহুয়া পাল্টে এ শব্দটি সরিয়ে ও শব্দটি তিনি প্রয়োগ করে বাংলা মহুয়া শব্দে স্থিত হয়েছেন। সে অর্থে জীবনের প্রথম গ্রন্থটি বাংলায় লিখলে ভালো হতো। তবে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে নিজের সৃষ্টি পৌঁছে দিতেই হয়ত এই সমঝোতা। ব্যক্তি জীবনে মহুয়া জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। বিপণনের জগতে ব্র্যান্ড  পরিচর্চা  বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন বিভিন্ন নামী সংস্থায়। এই মুহূর্তে সমাজ সাহিত্য নিয়ে পডকাস্টার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন।